ঢাকা,  শুক্রবার
১৮ অক্টোবর ২০২৪

Advertisement
Advertisement

কেন কারফিউ জারি করতে হলো

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৬ জুলাই ২০২৪

আপডেট: ০৯:৩৬, ৬ আগস্ট ২০২৪

কেন কারফিউ জারি করতে হলো

কোটা সংস্কার

কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নজিরবিহীন সংঘাত যেন থামছেই না। কোন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এতো কম সময়ের মধ্যে একশোর বেশি মানুষ নিহত হবার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।

বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কারফিউ জারি করা নতুন কোন বিষয় নয়। সহিংসতা যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় তখন তা নিয়ন্ত্রণের সর্বশেষ উপায় হিসেবে কারফিউ বিবেচনা করে সরকার।

সর্বশেষ কারফিউ জারি করার ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। সেটিও হয়েছিল ছাত্র বিক্ষোভ দমনের জন্য।

গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করে শুক্রবার পর্যন্ত দেশজুড়ে নজিরবিহীন এই সংঘাত শুধু তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। প্রতিদিনই বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা।

প্রথম দিন শুধু পুলিশ মাঠে থাকলেও এক পর্যায়ে তাদের সহায়তা করার জন্য সীমান্ত-রক্ষী বাহিনী বিজিবি নামানো হয়। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এরপরে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

কারফিউ এমন এক সময়ে জারি করা হলো যখন পুলিশ, ্যাব এবং বিজিবির সাথে বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে টানা চারদিন ধরে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে? সাবেক পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হক বলেন, এক অর্থে তো হয়েছেই। যেখানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন দখল করলো দুষ্কৃতিকারীরা। পুলিশ, বিজিবি সেটা ঠেকাতে পারলো না। এটা তো বড় ধরনের ব্যত্যয় বলে আমি মনে করি।  

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মনে করছেন, রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়নি। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানিয়েছেন, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে।

সেজন্যই বলা হয়েছে ইন এইড অব সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায়) তারা মোটেও ব্যর্থ হয় নাই। আমাদের কথা হচ্ছে, যেভাবে তারা কেপিআইগুলো (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) ধ্বংস করেছে এবং জনগণের ট্যাক্স-এর টাকায় যেসব স্থাপনা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে, সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য আমরা কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছি।

আইনমন্ত্রী আরও বলেন, যারা কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে তারা এই সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারা পরিষ্কারভাবে এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে যে এটা কিছু রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তাদের নেতাদের উস্কানিতে করছে। সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি কারফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো।

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, গত কয়েকদিনের সংঘাতের কারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়েছে। এতো পুলিশ, এতো ্যাব, এতো বিজিবি  সব নামানোর পরেও সরকার যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সেজন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।

কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এবার অভাবনীয় এক পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সহিংসতা যখন কয়েকটি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তখন পুলিশের জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু সংঘাত যখন বিভিন্ন জায়গায় এবং অলিগলিতে ছড়িয়ে যায়, তখন সেটির মোকাবেলা করা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।

সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক বলছেন, পুরো বাংলাদেশে শহরের আনাচে-কানাচে যেভাবে আন্দোলনের নামে দুর্বৃত্তরা ছড়িয়ে পড়ে, পুলিশ কেমনে পারবে? এতো এতো পুলিশ কোথায় পাবে? পুলিশের সংখ্যা তো সীমিত। এটা সম্ভব নাকি? সব জায়গায় একসাথে- উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ীকোথায় সহিংসতা হয় নাই? এতো পুলিশ কোথায় পাবে?

শুক্রবার ঢাকার আকাশে ক্রমাগত হেলিকপ্টার চক্কর দিয়েছে। যেসব এলাকায় বিক্ষোভের তীব্রতা বেশি ছিল সেসব জায়গায় হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন। বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন এই ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলে বর্ণনা করছেন।

তিনি প্রশ্ন তুলছেন, হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল মারা হয়েছে। এটা কি স্বাভাবিক বিষয়? সরকারের হাতে থাকা সব ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করার করার পরেও যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তখন কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো হয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি কারফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিক্ষোভ দমনের জন্য কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো সর্বশেষ পদক্ষেপ। এরপর আর কোন পদক্ষেপ বাকি থাকে না।

সাবেক পুলিশ প্রধান শহিদুল হক বলেন, এটাই সর্বশেষ উপায়। কারফিউ দেয়ার অর্থ হচ্ছে জনগণকে বলা যেতোমরা ঘরে থাক, বিনা প্রয়োজনে বাইরে আসবা না কারফিউ দিলে আইনমান্যকারী জনগণ ভেতরে থাকবে। যারা কারফিউ অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটাই সর্বশেষ। আর কী করার আছে? এটা ছাড়া তো আর কোন হাতিয়ার নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে যারা সহিংসতা করতে চায় তাদের ওপর সেটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি করে।

কারফিউ খুব স্বল্প সময়ের জন্য জারি করা হয়। বাংলাদেশে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে কারফিউ দুই থেকে তিন দিনের বেশি ছিল না। একেক সময় একেক প্রেক্ষাপটে জারি করা হয়েছিল।

রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি যখন সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় তখন কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়েছিল। সেই কারফিউ বলবৎ ছিল দুই দিন। তখন কারফিউ কাজ করেছিল। তখন জনগণ সেটা সমর্থন দিয়েছিল। এর মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিল।

কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভে সরকার যে বিচলিত হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে কোন বিক্ষোভ কিংবা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য কারফিউ জারি করতে হয়নি।

অতীতে যখন কারফিউ জারি করা হয়েছিল, তখন দেখা গিয়েছিল যে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও সেটি ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চরম সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কারফিউ জারি করা হলে সেটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ তৈরি করে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি নির্ভর করছে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করে তার ওপর।

কারফিউর সময় জরুরি সেবা সংশ্লিষ্ট অফিস ছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ থাকে। কারফিউর মেয়াদ যত বাড়তে থাকে তার সাথে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বাড়ে পাল্লা দিয়ে।

কারফিউ জারি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শনিবার ভোররাতে কোটা-বিরোধী আন্দোলনকারীদের সাথে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

Advertisement
Advertisement

Warning: Undefined variable $sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/dikdorshon/public_html/details.php on line 531