রাজধানীর মহাখালীতে গত ১৯ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদ হোসেনকে বেদম পিটিয়েছিল ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। শুধু তাই নয়, ১৮ বছর বয়সী এ তরুণের মৃত্যু নিশ্চিত করেই ঘটনাস্থল ছাড়ে পুলিশ। পরে জাহিদের বড় ভাইকে ধরার চেষ্টাসহ পরিবারকে হয়রানি করা হয়। সরকার পতনের পর বিএনপি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করতে চাপ দেওয়ায় মামলা করেনি জাহিদের পরিবার।
রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ায় রেললাইনের পাশে চারতলার চিলেকোঠায় টিনশেডের একটি ঘরে ছিল জাহিদ হোসেনের বাস। পূর্বদিকের জানালা দিয়ে চোখ মেললে দেখা যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা। উত্তরের জানালায় চোখ রাখলেই মহাখালী রেলগেট। গত ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এ দুই জায়গায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে। তখন নিজেকে সামলাতে পারেনি জাহিদ।
সেদিন ছররা গুলিতে আক্রান্ত হলেও বাসার কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। পরদিন ১৯ জুলাই বেলা ১১টার দিকে মহাখালী রেলগেটে হাজারো বিক্ষোভকারীর সঙ্গে যোগ দেয় সে। আন্দোলন থেকে ছেলেকে জোর করে ঘরে ফিরিয়ে আনেন জাহিদের বাবা জাহাঙ্গীর আলম, যাতে আন্দোলনে যেতে না পারে। ছেলেকে ঘরে আটকে দরজায় তালা দেন মা রাহেলা বেগম। ভাত খাওয়ার পর জাহিদ মায়ের পায়ের ওপর মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। একটি চিরুনি এনে চুল আঁচড়ে দিতে বলে।
রাহেলা বেগম বলেন, তখন বিকেল সাড়ে ৪টা বাজে। মহাখালীতে গোলাগুলি শুরু হলে অনেকের মতো আমিও নিচে যাই ঘটনা দেখতে। জাহিদ আমার সঙ্গে নামে। হঠাৎ দেখি ছেলে পাশে নেই। দৌড়ে চলে যায় কয়েকশ গজ দূরের মহাখালী রেলগেটে। পরে জাহিদের বন্ধুদের কাছে জানতে পারি, ও সবার আগে ছিল। বন্ধুদের বলে, ‘আমি শহীদ হমু। তোরা যা গা।’
বন্ধুদের এ কথা বলার পর দৌড়ে রেলগেট-সংলগ্ন মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে চলে যায় জাহিদ। সেখান থেকে পাশের ফুটপাতে যায়। তখনই শরীরে লাগে গুলি। জাহিদের বন্ধুদের বরাতে রাহেলা বেগম জানান, ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গুলি করা হয় জাহিদকে।
জাহিদের বড় ভাই রাহাত হোসেন মিরপুর বাঙলা কলেজ থেকে গত বছর এইচএসসি পাস করেন। তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ জাহিদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তখন তাকে পেটায় কয়েক ব্যক্তি। পরে জানতে পারেন, আন্দোলন দমনে পুলিশের সঙ্গে সেদিন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও ছিলেন। তবে তারা নাখালপাড়ার নন। এ কারণে কাউকে চিনতে পারেননি। মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদ পিটুনির পর নিথর হলে এক পুলিশ সদস্য পা দিয়ে জাহিদের শরীর উল্টেপাল্টে দেখেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ সেখান থেকে চলে যায়। পুলিশ যাওয়ার পর জাহিদের বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাকে আইসিইউতেও নেওয়া হয়েছিল। এর আগেই জাহিদের মৃত্যু হয়।
রাহেলা বেগম বিলাপ করে জানান, জাহিদের বাবা সন্ধ্যা ৬টার দিকে খবর পান ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু জাহিদের লাশ পেতে দেখা দেয় পদে পদে বিপত্তি। লাশ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এর পর আন্দোলনকারীরা গলিতে জাহিদের লাশ লুকিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার পর নিয়ে যান শাহীনবাগ মসজিদে। কিন্তু ভয়ে সেখানে লাশ গোসল করায়নি কর্তৃপক্ষ। পরে জানাজার জন্য জাহিদকে আনা হয় ঘরের পাশের হাজী মরণ আলী মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে। ওই দিন রাতে জাহিদকে স্থানীয় রহিম মেটাল কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জাহাঙ্গীর আলম জানান, তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ইসলামপুর গ্রামের বাড়িতেও দুই গাড়িতে ১২ থেকে ১৩ জন পুলিশ গিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
জাহিদ নিজে অংশ নিলেও বড় ভাইকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল, ‘তুমি থাক আব্বু আম্মুকে দেখতে।’ রাহাত এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘জাহিদের মৃত্যুর পর শুরু হয় পুলিশের হয়রানি। জাহিদের বন্ধু রাকিব, মেহেদি, ইমনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। আমি (রাহাত) কোথায় জানতে চেয়েছিল ওদের কাছে।’
রাহেলা বেগম বলেন, ‘এতে ভয় পেয়ে আমরা পালিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাই। সরকার পতনের পর ঢাকায় ফিরেছি।’ মামলা করেননি– এমন প্রশ্নে তাঁর চোখেমুখে ভয়ের ছায়া। পাশ থেকে রাহাত বলেন, এলাকার বিএনপি নেতারা নাখালপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করতে বলেছেন। এ কারণে মামলা আর করা হয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করতে চাপ দেওয়া বিএনপি নেতা কারা– প্রশ্নে রাহাত মুখ খুলতে চাইলেও রাহেলা বেগম বড় ছেলেকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। এ এলাকায় থাকতে হবে। কারও সঙ্গে শত্রুতা করতে চাই না। আমার ছেলেকে শেখ হাসিনা, পুলিশ এবং সেদিন রাস্তায় থাকা ছাত্রলীগ মেরেছে। আমি তাদের বিচার চাই। যারা নির্দোষ, তাদের আসামি করে জাহিদের আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে, জান্নাতে আছে। সেখানে শান্তিতে থাকুক।’
রাহাত জানান, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত কয়েকজন নেতাকর্মী দাফনে সহায়তা করেছিলেন। তাদেরও আসামি করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
জাহিদের ময়নাতদন্ত হয়নি। হয়নি সুরতহাল প্রতিবেদন। ইউনিভার্সেল হাসপাতাল থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যুসনদ পায়নি পরিবার। শুধু কবরস্থানের একটি সনদ আছে। তেজগাঁও থানার ওসি মোবারক হোসেন সমকালকে বলেন, পরিবারকে কেউ চাপ দিতে পারবে না। তারা যাদের অপরাধী মনে করে, তাদের নামে এসে থানায় মামলা করুক। পুলিশ অবশ্যই মামলা নেবে। ময়নাতদন্ত না হয়ে থাকলেও মৃত্যুসনদ এবং ছবি নিয়ে এলেও মামলা নেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের তালিকা করার ঘোষণা দিয়েছে। রাহেলা বেগম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ছাত্র বা সরকার, কেউ যোগাযোগ করেনি। জাহিদ সিভিল এভিয়েশন স্কুলে সিক্স পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। লেখাপড়া ছেড়ে ফুলের দোকানে কাজ করত। আমার এই ছেলেটাই সংসার চালাত। শুধু জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসে ১ লাখ টাকা দিয়েছেন। অন্য কেউ সহায়তা দেয়নি।’