নেমেই তারা ছুটোছুটি শুরু করলেন। এদিক-ওদিক তাকানোর সময়টুকুও নেই। নদীর ওপার থেকে গাট্টি বোঝাই খাবার নিয়ে এপারে এসেই কাজে লেগে গেলেন। ঘাট থেকে খাবারের বাটিগুলো আনা হলো তীরে, সুন্দর করে সাজিয়ে সেগুলো আবার তোলা হলো ভ্যানে।
মুম্বাইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের কথা শুনেছেন কখনো? শুনে না থাকলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যারা ডাব্বা (টিফিন বক্স) পৌঁছে দেন গন্তব্যে, তারাই মূলত ডাব্বাওয়ালা। ব্যস্ত শহর মুম্বাইয়ে এ ডাব্বাওয়ালারা প্রায় সবার কাছেই পরিচিত মুখ। কর্মব্যস্ত মানুষের কাছে নিজগৃহে তৈরি সুস্বাদু খাবার আনা-নেওয়ার কাজ করেন তারা।
ঠিক এমন কিছু 'ডাব্বাওয়ালার' দেখা মিলবে বুড়িগঙ্গার সোয়ারীঘাটে। তবে তাদের ডাব্বাওয়ালা বলা হয় না, তারা পরিচিত 'বুড়িগঙ্গার চাঙারিওয়ালা' নামে। নিজ চোখে দেখব বলে সেদিন বেরিয়ে পড়লাম তাদের সন্ধানে। ঘড়িতে তখন ১০টা বেজে কুড়ি। মাথার ওপর ভাদ্র মাসের সূর্যের পিচগলানো তাপ। কাঠফাটা এ রোদে মিনিট দুয়েক থাকলেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়।
বুড়িগঙ্গার সোয়ারীঘাটে উত্তাপ যেন আরও বেশি। তাই ছায়ার খোঁজে ঘর্মাক্ত পথচারীরাও উঁকি দিচ্ছেন এদিক-ওদিক। সুযোগ পেলেই জিরিয়ে নিচ্ছেন ক্লান্ত পথিকেরা। একদিকে প্রখর উত্তাপ, অন্যদিকে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি — সাধারণ কথায় যাকে বলে 'ভয়ংকর সুন্দর'।
অবশ্য মাঝে-মধ্যে শরীরজুড়ে মৃদু ঠান্ডা বাতাস বুলিয়ে যাচ্ছে। তীব্র তাপদাহেও সোয়ারীঘাটের কর্মব্যস্ত মানুষদের জিরিয়ে নেবার সময় নেই। যে যার কাজে ব্যস্ত। ঘাটের এক পাশে দশ–পনেরোটি নৌকার সারি। অপর পাশেও তাই। ক্লান্ত মাঝিরা বসে আছেন যাত্রীর অপেক্ষায়।
তাদের শার্ট ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, দেখে মনে হয় যেন নদীতে ডুব দিয়ে এসেছেন। কেউ কেউ হাতে পানি নিয়ে মাথা ভিজিয়ে নিচ্ছেন, এতে কিছুটা আরাম মেলে। ভাদ্র মাসের প্রখর রোদে 'কুকুর পাগল হওয়ার কথা' হয়তো এমনি এমনি বলেননি মুরব্বিরা।
নদীর এপার–ওপার পারাপার চলছে। রোদ থেকে বাঁচতে কেউ ছাতা মাথায় নিয়ে নৌকায় নদী পার হচ্ছেন। ঘাটের পাশে মিনিট কয়েক দূরত্বে একটি ছোট্ট চায়ের টং। কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি দুখানা টুল; কোনোরকমে তিন–চারজন বসতে পারেন।
দ্রুত গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। ছায়া পেয়ে মনে হলো শান্তি ফিরে এসেছে। চায়ের দোকানের অবস্থান এমন যে, পুরো নদীর দৃশ্যপটটাই দেখা যায় এখান থেকে। তাই আরাম করে দু'পা দুলিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করলাম চাঙারিওয়ালাদের খোঁজে।
দুপুর ১২টা পাঁচ মিনিটে ঘাটে দুটি ট্রলার এসে ভিড়ল। সে ট্রলারে দেখলাম তাদের। মাথায় মস্ত বড় একটি থালা, তাতে ৪০–৫০টি বাটি। থালাভর্তি বাটিগুলো মাথায় নিয়ে একে একে ট্রলার থেকে ঘাটে নামলেন তারা। সংখ্যায় দশ–পনেরোজন হবেন। আমিও ছুটলাম তাদের পিছু পিছু।
নেমেই তারা ছুটোছুটি শুরু করলেন। এদিক-ওদিক তাকানোর সময়টুকুও নেই। নদীর ওপার থেকে গাট্টি বোঝাই খাবার নিয়ে এপারে এসেই কাজে লেগে গেলেন। ঘাট থেকে খাবারের বাটিগুলো আনা হলো তীরে, সুন্দর করে সাজিয়ে সেগুলো আবার তোলা হলো ভ্যানে।
এবার দড়ি দিয়ে বাটিগুলোকে শক্ত করে বাঁধার পালা। দেওয়া হলো কয়েকটি গিঁট, যেন বাটিগুলো সুরক্ষিত থাকে। যা-ই হোক না কেন, দায়িত্বে কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। এরপর খাবার নিয়ে ভ্যানগাড়ি ছুটল নির্ধারিত গন্তব্যে, সঙ্গে চাঙারিওয়ালাও। নির্ধারিত দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া হবে প্রতিটি টিফিনবক্স।
বছরের পর বছর ধরে এভাবেই খাবার আনা-নেওয়ার কাজ করেন তারা। নদীর ওপার থেকে কর্মব্যস্ত মানুষদের বাড়ির গিন্নিদের তৈরিকৃত খাবারই বহন করেন। বলতে গেলে, বাড়ির খাবার আর কর্মস্থলের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনই তাদের একমাত্র কাজ।
সঠিক জায়গায় সঠিক খাবার বাটি পৌঁছে দেওয়ার কাজটি তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। একইসঙ্গে, সময়ের গুরুত্বও তাদের কাছে অপরিসীম। তাই দুপুর ১২টা থেকেই সোয়ারীঘাটে দেখা মেলে তাদের।
এ পেশায় কেউ কেউ আছেন ৪০ বছরেরও পুরোনো। যেমন জিঞ্জিরার মো. রফিক। বয়স ষাটের কোঠায়, পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার। কৈশোরেই বাস্তবতার চাপ তাকে গ্রাস করে, জীবিকার তাগিদে কাজ শুরু করেন।
শুরুর দিকে মালামাল বহনের কাজ করতেন, এরপর খাবার বাটি বহনের কাজে যুক্ত হন। ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে করছেন এ কাজ। প্রতিদিন সকালে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করেন খাবারের বাটি, তারপর নৌকো করে সেগুলো নিয়ে আসেন এপারে। খাওয়া শেষে সেসব বাটি আবারও সংগ্রহ করে যথাস্থানে পৌঁছে দেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এভাবেই কাটে তার দিন।
এ কাজ থেকে যে আয় করেন, তা দিয়ে সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে। তাই দীর্ঘদিন এই পেশায় বহাল রেখেছেন নিজেকে। এখন তার ১৭ বছরের ছেলেও এ কাজে যুক্ত হয়েছে। রফিকের সঙ্গে কাজ শিখছে সে।
'আপনের ঘরের ভাত আমাগো রাইন্ধা দিলেন, আমরা নিয়া হেগো দোকানে দিলাম। মাসে পনেরো–বিশ হাজার দেয়, মাঝেমধ্যে আরও বেশিও পাই,' বলেন রফিক।
বুড়িগঙ্গার ওপারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসে এ খাবার। মূলত চকবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজার, মিটফোর্ট, নওয়াববাড়ী, শাখারীবাজারের ব্যবসায়ীদের বাড়ির গিন্নিরাই রান্না করেন। চাঙারিরা সে খাবার তাদের হাতে পৌঁছে দেন। তাদের কাজ শুরু হয় সকাল ৮–৯টার দিকে।
প্রথমে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খাবারভর্তি বাটি সংগ্রহ করে আনেন। প্রতিটি চাঙারির নির্দিষ্ট এলাকা থাকে, একজন চাঙারিওয়ালা গড়ে ৪০–৫০টি বাটি সংগ্রহ করেন।
এ নিয়ে কথা হলো হালিমা খাতুনের সঙ্গে। তার বাড়ি কেরানীগঞ্জে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ নারী পনেরো বছর ধরে একাই কাজ করতেন, এখন তার ১৭ বছরের ছেলে রাফিও কাজের সঙ্গে যুক্ত।
রাফি খাবারের বাটি মাথায় বহন করে। ঠিক কোন কোন স্থান থেকে এসব খাবার আসে? হালিমা বলেন, 'জাউল্লাপাড়া, নারকেলভবাগ, বরিশূর, বোরহানীবাগ, টিনের মসজিদ, মান্দাইল, গদাবাগ থেইকা নিয়া আসি। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিইল্লা খাবার দেয়। ট্যাহাও মেলা পাই। কথা হইলো ভাগ বেশি পাইলে ট্যাহা বেশি পাই, আর যেদিন ভাগে কম পইড়া যায় সেদিন কম পাই।'
তবে দৈত্যাকার থালাভর্তি এতগুলো বাটি দেখে জানতে ইচ্ছে হলো, ঠিক কোন বাটি কার, সেটি কীভাবে চিহ্নিত করেন। উত্তরে গালভর্তি হাসি নিয়ে হালিমা বললেন, 'এইহানে অনেকেই নাম লেইখা দেয়, চিহ্ন দিয়া দেয়। এইসব না দিলেও চিনি। কোন থালা কোন জায়গায় যাইবো হেইডাও জানি। কোনো জায়গায় মেলা সময় কাম করলে এইডা হইয়া যায়।'
ঠেলাগাড়ি কোথায় যাবে, সেটাও আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়।
'প্রতিদিনই আমি তাদের দেখি। ২০–২২ বছর ধরে এখানে দোকান করি। প্রতিদিনই তারা আসেন, মালামাল ভ্যানে তোলেন, জায়গায়-জায়গায় দিয়ে আসেন, আবার নিয়েও আসেন। শুধু শুক্রবার এ কাজ বন্ধ থাকে তাদের। এটিও বেশ পুরোনো পেশা,' বলেন স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আলম।
বংশ পরম্পরায় এ পেশায় আছেন বুড়িগঙ্গার চাঙারিওয়ালারা। বয়সের ভারে শফিকুল আলমের বাবা কাজ করতে পারেন না, তাই তার জায়গায় শফিকুল এখন এ কাজ করছেন। ১০ বছর হলো তিনি এ পেশায় আছেন। অন্য কাজের চেয়ে এ কাজ তার কাছে আরামের এবং লাভজনক।
তিনি বলেন, 'তবে এ কামে সময়মতো কাম করতে হয়। লাঞ্চ আওয়ারের আগেই সব খাবার জায়গামতো দিয়া আসতে হয়। তাদের খাওন শেষ হইলে বাটিগুলা আবার নিয়া আসতে হয়। এরপরে হেগুলা সব এক কইরা বাসা-বাড়িতে দিয়া আসতে হয়।'
'মেলা দায়িত্ব। তয় ট্যাহাও ভালা পাই। এর লাইজ্ঞা কষ্ট লাগে কম,' বলেন এ চাঙারিওয়ালা।
তবে এ পেশায় প্রতিবন্ধকতাও আছে। কোনোভাবে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটলে বা দোকানপাট বন্ধ হলে চাঙারিওয়ালাদের কষ্টে দিন কাটে। করোনাকালীন সময়ে কষ্টের দিনগুলোর কথাও তুলে ধরেন কেউ কেউ। মো. রফিক বলেন, 'যদি কোনো কারণে দোকানপাট বন্ধ থাহে, তহন আমরা আর চলবার পারি না। কামাই করতে পারি না। হেগো কাজ না থাকলে খাওন কারে পাঠামু?'
ভারতে এ পেশার শুরু ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে হলেও বুড়িগঙ্গার চাঙারিওয়ালারা ঠিক কবে থেকে এ পেশায় যুক্ত, তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। কারও মতে ৫০ বছর, আবার কারও মতে এটি ৬০–৭০ বছরের পুরোনো পেশা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, নদীর এপারে যখন থেকে ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তখন থেকেই তারা এ কাজ করছেন।
যা-ই হোক, আধুনিক এ যান্ত্রিক যুগে, যেখানে সবকিছুই উচ্চমূল্যের, সেখানে স্বল্প খরচে বছরের পর বছর যে অকৃত্তিম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চাঙারিওয়ালার, কেবল পেশার প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসার কারণেই হয়তো তা সম্ভব।