Deprecated: str_replace(): Passing null to parameter #3 ($subject) of type array|string is deprecated in /mnt/volume_sgp1_05/dikdorshon/public_html/common/config.php on line 154
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর নেপথ্য নায়কেরা ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণ করে যা বললেন!

ঢাকা,  শুক্রবার
১৮ অক্টোবর ২০২৪

Advertisement
Advertisement

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর নেপথ্য নায়কেরা ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণ করে যা বললেন!

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৪:২৩, ৬ অক্টোবর ২০২৪

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর নেপথ্য নায়কেরা ভয়ঙ্কর স্মৃতি স্মরণ করে যা বললেন!

জুলাই গণহত্যা তাদের অবদান নিয়ে নিয়ে কিছুটা চাপা গর্ব নিয়ে প্রিয়া বলেন, “আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলাম। কিন্তু আমরা সেটা বলে বেড়াতে চাই না। আমাদের যা করার ছিল আমরা তাই করেছি। যদি প্রয়োজন হয়, আমরা আবারও তা-ই করব।"

শাহবাগের হিজড়া দলের অন্যতম সদস্য প্রিয়া। আমাদের সাক্ষাৎকারের শুরুতে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সব ভয়ঙ্কর সব স্মৃতি স্মরণ করেন তিনি। জিজ্ঞাসা করেন, "আপনি কি কখনও এমন কাউকে হাতে আগলে রেখেছিলেন যিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন?"

প্রিয়া বলেন, "এটি এমন এক অসহায়ত্ব ও বুকভার করা অনুভূতি যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।"

১৫ জুলাই সন্ধ্যায় প্রিয়া নাজিমুদ্দিন রোডের বাসাতেই ছিলেন, যেখানে তিনি তার দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই সেদিন তার কাজে যাওয়ার কথা ছিল, প্রাত্যহিক রুটিন অনুযায়ী টাকা তোলার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন থেকে তাদের উপার্জন প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে। কেননা সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল উত্তেজনা ও সহিংসতায় পূর্ণ।

শাহাবাগ এলাকার হিজড়া দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা প্রিয়া। ফেসবুক চালাতে চালাতে একটি ভিডিওতে তিনি দেখতে পান, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের, এমনকি মেয়েদেরও মারধর করছেন। এটি দেখে তিনি আর চুপ থাকতে পারেননি।

নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করে প্রিয়া বলেন, "আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার গুরু মাকে (শাহবাগের হিজড়া সম্প্রদায়ের নেতা মুক্তা) বলেছিলাম, 'আমরা শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা তুলে জীবন চালাই। তাদের বিপদ মানে আমাদেরও বিপদ। তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।"

মুক্তা তখন প্রিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, "তুমি কী করতে চাও?" প্রিয়া বলেন, "আমাদের যথাসম্ভব ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হওয়া দরকার।"

ডাকে সাড়া দেওয়া

ওই পরিস্থিতিতে হাবিবা, নদী, বৈশাখী ও মুগ্ধের মতো সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হন প্রিয়া। এমনকি তাদের ৭৫ বছর বয়সি প্রবীণ নেতাও ঘরে বসে থাকেননি। ১৬ থেকে ২৫ জুলাই সবচেয়ে সংকটের সময়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো এক অদম্য শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।

১৬ জুলাই হিজড়া সদস্যরা ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগে কাজ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ তা মানতে চায়নি। এমনকি তারা উল্টো প্রিয়াকে হুমকি দেয়। তাদের জিজ্ঞাসা করে, "আপনাদের এখানে কে আসতে বলেছে? আপনাদের নামে মামলা করা হবে।"

তবে হিজড়া সদস্যরা জানান, তারা নিজ ইচ্ছায় হাসপাতালে এসেছেন। তারা স্ট্রেচার ও আহতদের আনা-নেওয়ায় সাহায্য করছিলেন। কিন্তু তাদের ধারণাই ছিল না যে, সামনে আরও খারাপ সময় আসছে।

স্মৃতিচারণ করে প্রিয়া বলেন, "১৭ জুলাই এই ভয়াবহতা শুরু হয়েছিল। বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে বহু মানুষ আসছিল হাসপাতালে। এই তালিকায় শুধু পুরুষই নয়, নারী ও শিশুও ছিল।"

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি, অ্যাম্বুলেন্স ও মিনি ট্রাকে করে একের পর এক আহত ও মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হচ্ছিল। এদের মধ্যে বেশিরভাগকেই গুলি করা হয়েছিল। কারো হাতে, পায়ে, বুকে, গলায় কিংবা মাথায়। গাড়িগুলো আহত রোগী দিয়ে পূর্ণ ছিল।

কিন্তু হাসপাতালটিতে জনবলের অভাব ছিল। এমনকি উপস্থিত কয়েকজন কর্মী তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানেই প্রিয়া ও তার দল অবস্থান নেন। তারা মৃতদেহগুলো আনলোড করতে, স্ট্রেচারে রাখতে, ওষুধ ও রক্তের ব্যবস্থা করতে কিংবা মরদেহ মর্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন।

প্রিয়ার সাথে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা নদী ভারী কণ্ঠে বলেন, "আমাদের অবশ্যই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। মানুষ মারা যাচ্ছিল।"

রক্তদানের প্রাণকেন্দ্র

হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা যখন শুনলেন যে হাসপাতালে রক্ত ​​ফুরিয়ে আসছে, তখন তারা কায়িক পরিশ্রমের পাশাপাশি রক্তদান ক্যাম্পেইনের আয়োজন করেন।

এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ৩৬ জন হিজড়া রক্তদান করেন। একইসাথে তারা ৭৩০ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করেন। ওই সময়ে ভয়ের আবহে মোড়ানো রাজধানীতে এটি কোনো ছোট অর্জন নয়।

প্রিয়া জানান, তারা রক্তদান করার আর্জি জানিয়ে হাসপাতালের বাইরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, "আমরা সবাইকে রক্ত দিতে অনুরোধ করছিলাম। তারা কোথা থেকে এসেছে, সেটা আমরা চিন্তা করিনি। আমরা শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।"

হিজড়াদেরওইঐ দলটির পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকাও নগদ উত্তোলন করা হয়। ওই টাকা দিয়ে ওষুধ কেনা, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা এবং মরদেহগুলো তাদের পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর খরচ মেটানো হয়েছে।

প্রিয়া বলেন, "ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে না পারলেও আমরা ঠিকই রক্তের জন্য সিলিকন ব্যাগ সরবারাহ করেছিলাম। আর যারা রক্ত দিয়েছিলেন, তাদের জন্য পানি ও জুসের ব্যবস্থা করেছিলাম।"

নৃশংসতার মুখোমুখি

প্রিয়া ও তার দল ওই সময়ে চলমান নৃশংসতা একদম কাছ থেকে দেখেছেন। দেহের ভেতরে বুলেটের ক্ষত, বিস্ফোরণে আহতদের বিকৃত হয়ে যাওয়া চিনতে না পারা চেহারা এবং অ্যাম্বুলেন্সের করে হাসপাতালের ধারণাক্ষমতার চেয়েও বেশি মানুষ আসার দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছেন।

প্রিয়া এমনই এক ঘটনার কথা স্মরণ করেন। এক আহত ছেলেকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার মাথার অর্ধেক উড়ে গিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে আহত অবস্থায় আসা  অনেকেরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশ কম।

প্রিয়া জানান, "চিকিৎসকেরা বলছিলেন, শুধু হাতে বা পায়ে গুলি লেগেছে বিষয়টি এমন নয়। বরং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে গুলি লেগেছে।"

প্রিয়া ও তার দল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। প্রায়শই ভোর ৪টা কিংবা ৫টা পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতেন। পরদিন সকাল ১১টায় আবার কাজে ফিরতেন তারা।

প্রিয়া বলেন, "আমরা বিশ্রাম নিতে পারিনি। সেখানে অনেক লোক ছিল যাদের আমাদের প্রয়োজন ছিল।"

সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেও হিজড়া সম্প্রদায়কে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। যারা কি-না স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ভাড়া নিচ্ছিল।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে প্রিয়া বললেন, "তারা এটা কীভাবে করতে পারলেন?"

প্রিয়া আরও বলেন, "আমরা কিছু অ্যাম্বুলেন্স চালককে চিনতাম। আমরা তাদের সাহায্য করার জন্য ডেকেছিলাম। কিন্তু যখন আর কাউকেই পাইনি তখন অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।"

১৮ জুলাই এক স্কুলছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। তার বাবা ঝিনাইদহের একজন রিকশাচালক। ছেলের লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তার ছিল না।

ছেলেটির শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

ঐ ঘটনার স্মরণে প্রিয়া বলেন, "ছেলেটির বাবা ভেঙে পড়েছিলেন। তার ছেলের লাশ বাড়িতে নেওয়ার মতো টাকাও ছিল না। রাতও হয়ে যাচ্ছিল। আমরা তখন ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা অ্যাম্বুল্যান্স যোগাড় করি। যাতে লোকটি তার সন্তানের লাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে।"

মৃত্যুর শোক সহ্য করা

এবার অনেকটা মৃদু স্বরে প্রিয়া বলেন, "আহতদের আমরা নিজ হাতে আনা-নেওয়া করছিলাম। আমরা যাদেরকে ভেতরে পাঠাচ্ছিলাম, তারা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই মারা যাচ্ছিলেন।"

হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি এখনও দলটিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এমনটা অবশ্য হওয়ার কথাই ছিল।

প্রিয়ার জন্য সবচেয়ে পীড়াদায়ক মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি ছিল যখন তিনি ২২ বছর বয়সী রিফাতের মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঠিক এই ছেলেটিই ১৭ জুলাই থেকে লাগাতার তাদের সাহায্য করছিলেন। ১৯ আগস্ট তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

প্রিয়া বলেন, "ছেলেটি লংমার্চে যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরদেহের কাতারে নাম লেখান। তার পরিবারও জানতেন না যে, সে মারা গেছেন। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু নেই।"

প্রিয়া আরও বলেন, "ঐ দিনগুলোতে আমাদের শরীর রক্তে ভেসে যেত। এমনকি এমন দিনও ছিল যখন রক্তের গন্ধে খাওয়া-দাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।"

হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রিয়া ও তার দলের সদস্যরা উদযাপন করতে পারেনি। তিনি বলেন, "এমনকি ৫ আগস্ট সন্ধ্যায়ও হাসপাতালে মরদেহ আসছিল।"

প্রিয়া মনে করেন, ঐ দুর্বিষহ সময়ে আহত ও নিহতদের পরিবারের সরকারি সহায়তা পাওয়া উচিত।

তিনি বলেন, "মুক্তিযোদ্ধারা যেমন পেনশন পান, তেমনি এই শহীদদের পরিবারেরও পাশে দাঁড়ানো উচিত। তারা দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তাদের পরিবারের সাহায্য দরকার।"

তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুটি পর্যায়ে মোট ১৬ দিনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। প্রথমটি ১৬ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত এবং তারপর ১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত।

Advertisement
Advertisement

Warning: Undefined variable $sAddThis in /mnt/volume_sgp1_05/dikdorshon/public_html/details.php on line 531