দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি শিল্পের মূল ভিত্তি বিটকয়েন। বিশ্বের বৃহত্তম বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এর মাধ্যমে লেনদেন করে। একটি দেশে (এল সালভাদর) তো অফিশিয়াল মুদ্রা হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে বিটকয়েন। তবে এই ক্রিপ্টোকারেন্সির উল্কার গতিতে উত্থানের মাঝেও একটি গভীর রহস্যের উত্তর এখনও অজানাই রয়ে গেছে—বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতা, রহস্যময় সাতোশি নাকামোতো, আসলে কে?
অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আজতক কেউ সফল হননি। অক্টোবরে এইচবিওর একটি ডকুমেন্টারিতে বলা হয়েছিল, কানাডিয়ান বিটকয়েন বিশেষজ্ঞ পিটার টডই আসলে সাতোশি। তবে এই দাবির সমস্যা একটাই—পিটারই খোদ এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। ক্রিপ্টো-জগতও এইচবিওর সেই দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি।
কাজেই বৃহস্পতিবার যখন খবর আসে, বিটকয়েনের স্রষ্টা সংবাদ সম্মেলনে এসে নিজের পরিচয় প্রকাশ করবেন, তখন সংবাদমাধ্যমসহ গোটা ক্রিপ্টো দুনিয়ার কৌতূহল ফের তুঙ্গে ওঠে।
সাতোশি নাকামোতোকে নিয়ে এমন গভীর আগ্রহের কারণ হচ্ছে, তাকে ক্রিপ্টো শিল্পের গোড়াপত্তনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা একজন বিপ্লবী প্রোগ্রামার মনে করা হয়।
তার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিপ্টো শিল্পে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আর এ শিল্পের ভক্তরা অত্যন্ত উৎসাহী ও নিবেদিতপ্রাণ।
তবে তাকে নিয়ে উন্মাদনার আরেকটি বড় কারণ হলো, সাতোশি এক মিলিয়নেরও বেশি বিটকয়েনের মালিক। বিটকয়েনের বর্তমান মূল্য প্রায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় তিনি এখন কয়েক মাল্টি-বিলিয়নিয়ার।
সেই বিশাল সম্পত্তির কথা ভাবলে বৃহস্পতিবার ডাকা সংবাদ সম্মেলনের জন্য প্রবেশ ফি নেওয়ার ব্যাপারটা খটকাই জাগায়। সংবাদ সম্মেলনে সামনের সারির আসনের জন্য ১০০ পাউন্ড এবং সীমাহীন প্রশ্ন করার সুযোগের জন্য আরও ৫০ ডলার ফি নেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক চার্লস অ্যান্ডারসন আরও ৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে বিবিসির একজন প্রতিবেদককে মঞ্চে 'সাতোশির' সঙ্গে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। তবে বিবিসির প্রতিনিধি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
তবে শেষে দেখা গেল, সাংবাদিক সম্মেলনে মাত্র এক ডজন সাংবাদিক হাজির হয়েছেন। খানিক বাদেই স্পষ্ট হয়ে গেল, উপস্থিত সকলেই এ আয়োজন নিয়ে সন্দিহান।
খানিকক্ষণ অনুসন্ধানের পর জানা গেল, সংবাদ সম্মেলনের আয়োজক ও নিজেকে সাতোশি দাবি করা দুজনেই বর্তমানে একটি জটিল প্রতারণা মামলায় জড়িত। মামলাটি ওই ব্যক্তির নিজেকে সাতোশি দাবি করা-সংক্রান্ত।
সুরুটা মোটেই আশাজাগানিয়া হলো না। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
আয়োজক চার্লস অ্যান্ডারসন 'সাতোশি'কে মঞ্চে আসতে আমন্ত্রণ জানান।
তার আমন্ত্রণে এতক্ষণ একপাশে চুপচাপ বসে থাকা স্টিফেন মোল্লাহ নামে এক ব্যক্তি উঠে এসে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিলেন: 'আমি এখানে ঘোষণা করতে এসেছি যে হ্যাঁ, আমিই সাতোশি নাকামোতো। আমিই ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে বিটকয়েন তৈরি করেছি।'
সাংবাদিকরা প্রথমে মজা পেলেও পরের এক ঘণ্টায় সেই আমোদ পরিণত হয় বিরক্তিতে। কারণ, স্টিফেন মোল্লাহ তার দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
স্টিফেন মোল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি একেবারে প্রথম তৈরি করা বিটকয়েনগুলো আনলক ও সেগুলোর সঙ্গে 'ইন্টারঅ্যাক্ট' করবেন। এ কাজ একমাত্র সাতোশিই করতে পারেন।
কিন্তু তিনি কাজটি করেননি।
এরপর হতাশ সাংবাদিকরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তারা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন, এবারও সাতোশিকে প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হলো।
বহু 'সাতোশি'র খোঁজ পাওয়া গেছে
সাতোশি নাকামোতো হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এমন মানুষের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু তাদের একজনও সাতোশি বলে প্রমাণিত হননি।
২০১৪ সালে নিউজউইকের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল, সাতোশি হলেন ডোরিয়ান নাকামোতো নামে এক জাপানি-আমেরিকান ব্যক্তি। থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়।
তবে ডোরিয়ান এই দাবি অস্বীকার করেন। দাবিটিও মুখ থুবড়ে পড়ে।
এর এক বছর পর অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ক্রেইগ রাইটকে সাতোশি বলে দাবি করেন সাংবাদিকরা।
রাইট প্রথমে এ দাবি অস্বীকার করেন, পরে আবার বলেন দাবিটি সত্য। কিন্তু পরের বহু বছরে এ দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। পরে লন্ডনের হাইকোর্ট রায় দিয়ে বলেছেন, রাইট বিটকয়েনের স্রষ্টা নন।
ধনকুবের ও ক্রিপ্টোপ্রেমী ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের একজন সাবেক কর্মী বলেছিলেন, এই ক্রিপ্টোকারেন্সির নেপথ্যের মানুষটি মাস্ক। কিন্তু এই ধনকুবের সাবেক কর্মীর দাবি নাকচ করে দেন।
এখন প্রশ্ন হলো: বিটকয়েনের স্রষ্টার পরিচয় জানা কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ?
ক্রিপ্টো বাজারের বর্তমান মূল্যায়ন বলছে, এটি গুগলের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আর আমাদের জীবনে এত বিশাল ভূমিকা রাখা প্রযুক্তি জায়ান্টের নেপথ্যের মানুষটি সবার অজানাই থেকে যাবেন—এ কথা হজম হতে চায় না।
প্রকৃত সাতোশির পর্দার আড়ালে থাকার সম্ভবত সংগত ও সউক্তিক কারণ আছে। তার বিটকয়েনের আনুমানিক মূল্য ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর তাকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তার জীবন ও স্বভাব-চরিত্র নিয়ে যে রীতিমতো কাটাছেঁড়া হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এইচবিও ডকুমেন্টারিতে সাতোশি হিসেবে নাম আসা পিটার টড বলেন, এই অনাকাঙ্ক্ষিত মনোযোগের কারণে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সাতোশি-রহস্য যে আজও ভেদ করা যায়নি, এই ব্যাপারটি ক্রিপ্টো জগতের অনেকেই উপভোগ করেন।
এ ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্যতম মূল ডেভেলপার (তাকেও সাতোশি বলে সন্দেহ করা হয়) সম্প্রতি এক্স-এ পোস্টে বলেছেন, 'কেউ জানে না সাতোশি কে—এটা একটা ভালো ব্যাপার,'
বিটকয়েন পডকাস্টার নাটালি ব্রুনেল মনে করেন সাতোশির এভাবে পরিচয় গোপন রাখাটা স্রেফ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই নয়, বরং তার অজ্ঞাতপরিচয় থাকা অপরিহার্যও বটে।
নাটালি বিবিসিকে বলেন, 'প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে সাতোশি নিশ্চিত করেছেন, বিটকয়েনের কোনো নেতা বা কেন্দ্রীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব থাকবে না, যার ব্যক্তিগত এজেন্ডা প্রটোকলকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।'
নাটালি বলেন, এর ফলে মানুষ কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির বদলে বিটকয়েনকে একটি সিস্টেম হিসেবে বিশ্বাস করতে পারছে।
বিটকয়েনের ইতিহাস নিয়ে পড়ান সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ক্যারল আলেকজান্ডার। তিনি অবশ্য ক্যারলের মতো এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।
ক্যারলের মতে, সাতোশি নাকামোতোকে নিয়ে যে 'সার্কাস' চলছে, তা আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে মানুষের নজর সরিয়ে দিচ্ছে। সেই প্রশ্নটি হচ্ছে: ক্রিপ্টোকারেন্সি কীভাবে অর্থনীতির কাজের পদ্ধতিকে বদলে দিতে পারে।
তবে শেষ কথা হচ্ছে, আপাতত সাতোশির অনুসন্ধান আরও প্রলম্বিত হলো। কে জানে, হয়তো অনন্তকাল ধরেই তাকে খুঁজে যাবে মানুষ।