গত ৪ আগস্টের পর থেকে হাসপাতালেই দিন কাটছে ২২ বছর বয়সী মো. হাসানের। সে সাথে হাসপাতালেনির্ঘুম দিন কাটছে চল্লিশোর্ধ্ব মা মাহেনূর বেগমের। ছেলের মুখে কোন কথা নেই। কোমায় থাকা ছেলের মুখে কবে মা ডাক শুনবেন সে অপেক্ষায় দিন কাটছে তার।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন হাসান। দীর্ঘ এক মাস চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন তিনি । ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের এইচডিওতে। সেখানে আছেন এক মাস ১৭ দিন ধরে। হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষায় দিন কাটছে মাদরাসা পড়ুয়া ১৭ বছর বয়সী বোন সুমাইয়া ইয়াছমিন সূবর্ণার।
তিনি বলেন, ‘ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি। সেই থেকে বাবার স্নেহ ভালোবাসায় আমাদের বড় করেছেন ভাইয়া। পড়ালেখা করিয়েছেন। কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি। যখন যা চেয়েছি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মন খারাপের দিনে এক সঙ্গে ঘুরতে নিয়ে যেতেন ভাইয়া। ভাইয়ার এ অবস্থা দেখে মা প্রায়ই বেহুঁশ হয়ে পড়েন। তাই মাকে একা রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। মায়ের সঙ্গেই আজ দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন মাস হাসপাতালের করিডোরে দিন কাটছে আমাদের।’
আরেক বোন সুলতানা আখতার জয়নব। বয়স ১৯ বছর। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। যিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। জয়নবও চট্টগ্রাম নগরের হালি শহরের একটি কাওমী মাদরাসায় পড়ছেন।
তিনি বলেন, ‘ভাইয়া নিজে পড়ালেখা না করে আমাদের পড়িয়েছেন। অনেক কষ্টে আমাদের মানুষ করেছেন। ভাইয়ার সুস্থতার জন্য মহান রবের কাছে প্রতিনিয়তই দোয়া করছি। অনেক আশা ছিল আমাদের দুইবোনের ভাইকে নিয়ে। কিন্তু আজ ভাই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে’এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন জয়নব ।
গত ৪ আগস্ট আহত হওয়ার পর হাসানকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়। দীর্ঘ একমাস আইসিইউতেই ছিলেন হাসান। পরে নেয়া হয় সিএমএইচে। বর্তমানে তার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসানের মা।
হাসানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার রামগতি ইউনিয়নের সুবর্ণচর গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ সেলিম গ্রামেই ছোট একটি চায়ের দোকান করতেন। ২০০৮ সালে এক দুর্ঘটনায় হাসান তার বাবাকে হারান। এরপর শুরু হয় পারিবারিক টানাপোড়েন। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন হাসান।
অনেক কষ্টে হালিশহর গরীবে নেওয়াজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পারিবারিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় পড়ালেখার ইতি টানতে হয়েছে তাকে।
এরপর কাজ শুরু করেন গ্যারেজে। আর মা কাজ নেন গার্মেন্টসে। অনেক কষ্টে ছোট দুই বোন ও হাসানকে লালন-পালন করেছেন মা। একা সংসার সামলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও করিয়েছেন তিনি।
গত ৪ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দেন হাসান ও তার বন্ধু শহিদুল ইসলাম সৈকত। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহিদুল ইসলাম সৈকত বলেন, ৪ আগস্ট পূর্বঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিই আমরা দুই বন্ধু। দুপুর ২টার দিকে আমাদের অবস্থান ছিল টাইগারপাসের সিআরবি রোডে। এ সময় আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়। এক পাশে পুলিশ, অপর পাশে আওয়ামী লীগের লোকজন অবস্থান করছিল। পুলিশ তখন টিয়ারশেল ছুঁড়ে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় যখন পুরোটা অন্ধকার তখন অপর দিক থেকে গুলি এসে লাগে হাসানের মাথায়। গুলি এক পাশে লেগে অপর পাশে বেরিয়ে যায়। তখন আমি তাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তিনি বলেন, হাসান আইসিইউতে থাকার শুরু থেকেই আমি তার সাথে ছিলাম। অনেকে সহযোগিতা করেছে। ঢাকা থেকে সমন্বয়ক সারজিস ভাই এসেছেন। তিনি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন। তারা ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, গুলি লেগে হাসানের মাথা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কিছু মগজও বেরিয়ে গেছে। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বহন করছে।
একমাত্র ছেলের এই অবস্থায় দিশেহারা হাসানের মা মাহেনূর বেগম। তিনি বলেন, এখন শুধু আল্লাহকে ডাকছি। জানি না এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারব কিনা। ১৬ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে যে কষ্ট পেয়েছি, সেটা তিন সন্তানকে দিয়ে লাঘব করার চেষ্টা করেছি। এখন আবার সেই কষ্ট।
তিনি বলেন, ছেলেটাকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছি। গত বছর ছোট্ট একটা কাজে যোগ দিয়েছে। আমি এতদিন চাকরি করেছি। মেয়েরা বড় হয়েছে। ভাবছি এবার অবসর নেব। এখন এই অবস্থায় আমি একেবারে দিশেহারা। কি করব, কি হবে বুঝতে পারছি না।
ডাক্তারের বরাত দিয়ে মাহেনূর বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসান কোমায় আছে। মাঝে মাঝে কোমা থেকে জাগে, কিন্তু কোনো কথা বলে না। শুধু চোখ খুলে তাকায়।
আহত হাসান চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর নয়া বাজারে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। এখন পুরো পরিবারের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়।