![কাঠমিস্ত্রির কাজ করে গড়ে তুলেছেন বিশাল পাঠাগার কাঠমিস্ত্রির কাজ করে গড়ে তুলেছেন বিশাল পাঠাগার](https://www.dikdorshon.com/media/imgAll/2024October/01-2502050824.jpg)
নারায়ণ চন্দ্র হালদার
মানুষের অর্জন উদ্যাপনের। তবে বিপদের সময় সেই আনন্দস্মৃতিই যেন বোঝা হয়ে যায়। এখন এমনই এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কাঠমিস্ত্রি নারায়ণ চন্দ্র হালদার।
ঝালকাঠি শহরে মানুষকে বই পড়ানোর জন্য নারায়ণ পরিচিতি পেয়েছেন। সুবচন শুনেছেন অনেকের। তাঁকে নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিবেদনও করেছে।
তিল তিল করে গ্রন্থাগার গড়ে নারায়ণ সত্যি এক বড় অর্জনের অধিকারী হয়েছেন। ২০টি থেকে এখন তাঁর প্রায় ৯ হাজার বই আছে। তিনি তৈরি করেছেন অগুনতি পাঠক।
এসবই নারায়ণ করেছেন গত প্রায় দুই যুগের চেষ্টায়। তবে এখন তাঁর গ্রন্থাগারটি সরিয়ে নিতে হয়েছে। এ অবস্থায় বইয়ের বোঝার সঙ্গে যোগ হচ্ছে গত দুই যুগের শ্রম, ত্যাগ, স্বপ্ন ও স্মৃতির ওজন। আর সেসব বহন করতে হচ্ছে একা নারায়ণকেই।
ঝালকাঠি শহরের অনেক মানুষের স্মৃতিতে আছে দুই যুগ আগে বই নিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক তরুণের কথা। তিনি নিজ উদ্যোগে বই কিনে মানুষকে পড়াতে চাইতেন। পৌঁছে দিতেন তাঁদের বাড়ি বাড়ি।
এভাবে নিজেই যেন এক ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার হয়ে উঠেছিলেন নারায়ণ। তখন প্রায় চার বছর ঝালকাঠি শহরে এমন সেবা দিয়েছেন বলে প্রথম আলোকে জানালেন তিনি।
এরপর শহরে নিজের ভাড়া বাড়ির একচিলতে বারান্দায় শুরু করেন বই পড়ার ব্যবস্থা। দ্রুতই বাড়তে থাকে পাঠক। একপর্যায়ে শহরের উদ্বোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিপণিবিতানের ভেতরে দুই কক্ষ নিয়ে গড়ে তোলেন ‘নারায়ণ মিস্ত্রি গ্রন্থাগার’।
পেশায় কাঠমিস্ত্রি নারায়ণ নিজের আয়ের অংশ বাঁচিয়ে এই গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। শুধু বই রাখার তাকগুলো তৈরি করতেই তাঁর খরচ হয় পৌনে এক লাখ টাকা। এ ছাড়া পরিচালনা ব্যয় তো আছেই।
কোনো কোনো বছর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পান নারায়ণ। তবে একটি গ্রন্থাগার পরিচালনার বিপুল ব্যয়ের বিপরীতে বছরে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকার অনুদানে খুব বিশেষ উপকার হয় না বলে জানান তিনি।
২০১৩ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত হয় নারায়ণের গ্রন্থাগার। দীর্ঘদিন ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত ছিল। বছর দুই আগে গ্রন্থাগারটি ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নীত হয়। বছরে একবার করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে বই ও সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পান তিনি।
ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পত্রিকার বিলসহ গ্রন্থাগারের নানা খরচের বড় অংশ নারায়ণকে ব্যয় করতে হয় নিজের পরিশ্রমের আয় থেকে। তিনি আয় করেন কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করে। মানুষের মুখাকৃতি খোদাই করে তোলেন কাঠের ওপর। এই শ্রমসাপেক্ষ কাজ থেকে যেটুকু আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান। পাশাপাশি ২৩ বছর ধরে চালিয়ে আসছেন গ্রন্থাগারটি।
এই গ্রন্থাগারের পাঠক কামরুল হাসান বলেন, নারায়ণ একজন কাঠমিস্ত্রি হয়েও নিজের শ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে গ্রন্থাগারটি গড়ে তুলেছেন। এখানে তিনি (কামরুল) নিয়মিত পড়াশোনা করেন। অন্যদেরও আসতে বলেন। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলের ১৫টি খণ্ড, ভারতীয় দর্শন, রবীন্দ্ররচনাসংগ্রহসহ অনেক দুর্লভ বই আছে।
গ্রন্থাগারটির কারিগর নারায়ণ বললেন, ‘গ্রন্থাগার হচ্ছে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সাল থেকে মানুষের বাড়িতে গিয়ে নিবন্ধনের মাধ্যমে বই পড়িয়ে কয়েক হাজার পাঠক তৈরি করেছি। অনেক বই ফেরত পাইনি। তারপরও আমি খুশি, মানুষের মধ্যে বই পড়ার আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি।’
৪০ বছর আগে ফি জমা দিতে পারেননি বলে নারায়ণ এসএসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ক্লাসে একবার অঙ্কে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯০ পেয়েছিলাম। সাতটির জায়গায় আটটি অঙ্ক করে ফেলায় শিক্ষক রাগ করে ১০ নম্বর কেটে দিয়েছিলেন। সেই আমার কিন্তু আর পড়ালেখা হলো না অভাবের কারণে।’
নারায়ণ বলছিলেন, সহপাঠীরা স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁকে ডাক দিত। বলত, ‘এ নারায়ণ, স্কুলে যাবি না?’ তখন তাঁর খুব খারাপ লাগত। কিছুদিন পর তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানে গিয়ে কাঠের কাজ শেখেন। কিন্তু যে কাজ শিখে ফিরে আসেন, তা গ্রামে চলে না। তাই ঝালকাঠি শহরে এসে একটা ফার্নিচারের দোকানে কাজ শুরু করেন। দিনে মজুরি ৪৫ টাকা। এভাবে তাঁর শুরু।
নারায়ণের গ্রন্থাগারে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনসহ বহু বিখ্যাত মানুষের কাঠচিত্র। এসব তাঁর নিজের হাতে নকশা করা। আসবাব ছাড়াও কাঠের নকশায় ছবি এঁকে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। কারও ছবি একবার দেখে কাঠের ওপর তাঁর মুখের রূপ দিতে পারেন তিনি।
স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে নারায়ণের পরিবার। ছেলে থাকেন প্রবাসে। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট মেয়ে ঝালকাঠি সরকারি কলেজে বিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবার নিয়ে নারায়ণ থাকেন ঝালকাঠি সদরে ভাড়া বাড়িতে। নারায়ণ বলেন, গ্রন্থাগারের ভাড়া বাকি পড়েছিল। তাই তাঁকে উঠে যেতে বলা হয়।
অর্থের অভাবের সঙ্গে আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়। যে দুজনের কাছ থেকে কক্ষ ভাড়া নিয়ে নারায়ণ গ্রন্থাগার গড়েন, তাঁদের একজন সরে গেছেন। তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জামানতের টাকা তুলে নিয়েছেন। ফলে বিপদে পড়েন নারায়ণ।
নারায়ণ জানালেন, সম্প্রতি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা তাঁর গ্রন্থাগারে এসেছিলেন। তিনি সংকটের কথা শুনে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উদ্যোগও আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে যায়। প্রায় দুই যুগের অর্জন নিয়ে নারায়ণ এখন বিপদে। ইতিমধ্যে গ্রন্থাগারের সব বই তিনি সরিয়ে নিয়েছেন অন্য জায়গায়।
গ্রন্থাগারের বিপুলসংখ্যক বই নিয়ে নারায়ণ এখন কী করবেন, তা নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। আর পাঠকেরা বই পড়তে এসে ফিরে যাবেন, সে কথা ভেবে তিনি মনঃকষ্টে ভুগছেন।
নারায়ণ বলছিলেন, ‘মানুষের টাকা হলে নিজের জন্য বাড়ি তৈরি করে। আর আমি কাঠমিস্ত্রি হয়ে গ্রন্থাগার করেছি, পাঠক তৈরি করেছি। সেই অর্জনও যদি ধরে রাখতে না পারি, তা কী যে কষ্টের, বোঝানো যাবে না।’