
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক পদে বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী হওয়ার সময় কানাডার নাগরিক ছিলেন। যদিও তিনি বাংলাদেশের পক্ষে প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁর নাগরিকত্বের বিষয়টি নৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
দ্বৈত নাগরিকত্ব ও আইনগত জটিলতা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সায়মা ওয়াজেদ দ্বৈত নাগরিকত্বের আনুষ্ঠানিক সনদ নেননি। তবে ২০০৮ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কানাডার ক্ষেত্রে এই সনদ বাধ্যতামূলক নয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কানাডার পাসপোর্ট পেয়েছেন, যার মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হবে। ২০২৩ সালে তাঁকে আবার নতুন পাসপোর্ট দেওয়া হয়, যার মেয়াদ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশি পাসপোর্টও তিনি নবায়ন করেছেন ২০২১ সালে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ব্যক্তি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। সরকারি চাকরি আইনে সরকারি কর্মচারীদের বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ নিষিদ্ধ। তবে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থায় পদ নেওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো নিয়ম নেই।
স্বজনপ্রীতির অভিযোগ
ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক পদে সায়মা ওয়াজেদের মনোনয়ন নিয়েও শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট এক প্রতিবেদনে বলেছিল, এ ধরনের স্বজনপ্রীতি ডব্লিউএইচওর বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষতি করবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁর মনোনয়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা হয়। নেপালের প্রার্থী শম্ভু প্রসাদ আচার্য, যিনি ডব্লিউএইচও সদর দপ্তরের একজন পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং জনস্বাস্থ্যে ডক্টরেটসহ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রাখতেন, তাঁর তুলনায় সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
দুর্নীতির অভিযোগ
দুদক বলেছে, সায়মা ওয়াজেদ রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে ডব্লিউএইচওতে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কিত তথ্য যথাযথ ছিল না। এছাড়া, তাঁর ভোটাভুটি উপলক্ষে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করা হয়েছে।
দুদকের আরও অভিযোগ, সায়মা ওয়াজেদ পূর্বাচলের কূটনৈতিক জোনে ১০ কাঠার একটি প্লট অবৈধভাবে নিয়েছেন। ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা নিয়েছেন এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। এনবিআরের সঙ্গে যোগসাজশ করে সূচনা ফাউন্ডেশনের কর মওকুফ করানোর অভিযোগও রয়েছে।
নতুন সরকারের অবস্থান
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতন হলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে ডব্লিউএইচওর কোনো যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর জানান, বর্তমান সরকার এ বিষয়ে নতুন কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, "ডব্লিউএইচওর মতো সংস্থা নৈতিকভাবে প্রশ্নহীন ব্যক্তিদের উচ্চ পদে দেখতে চায়। সায়মা ওয়াজেদের উচিত হবে নিজ থেকেই পদত্যাগ করা।"
সায়মা ওয়াজেদের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও তাঁর নিয়োগ নিয়ে চলমান বিতর্ক আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।