
বাংলাদেশ ব্যাংক
দেশের ব্যাংকখাত বর্তমানে দ্বিমুখী সংকটে বিপর্যস্ত—একদিকে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়, যা ৫ বছরে বেড়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা।
২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটিতে—বৃদ্ধির হার প্রায় ৩ গুণ। এখন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় বিতরণ করা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশই পরিণত হয়েছে খেলাপিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নামহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঋণ অনুমোদন, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও দুর্বল তদারকি এ বিপর্যয়ের মূল কারণ। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো—এই বিপুল ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো খুব সামান্যই সম্পদ সুরক্ষিত রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বড় খেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের পরিকল্পনার কথা জানালেও, সে কার্যক্রম এখনো গতি পায়নি। আর বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর প্রক্রিয়া জটিল এবং দীর্ঘসূত্রতাপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “প্রথম ধাপে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এরপর আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা চলবে।”
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পাচার হওয়া অর্থের উৎস যেমন জটিল, তেমনি তা ফিরিয়ে আনার আইনি লড়াইও সময়সাপেক্ষ। বিভিন্ন দেশ যেমন সিঙ্গাপুর বা সাইপ্রাসের আইন ও সহযোগিতা নির্ভর করে অর্থ ফেরত আসবে কিনা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেয়ে দেশে থাকা সম্পদ উদ্ধার সহজ। তবুও হাল ছাড়া যাবে না। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কৌশলগত পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য এখন প্রকাশিত হওয়ায় সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে। আগে এসব গোপন রাখা হতো। এখন প্রকাশ হওয়ায় পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র সামনে এসেছে।
তবে এই বাস্তব চিত্র আমানতকারীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকগুলো আয় হারাচ্ছে, মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে, এমনকি অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন অনুপাত রক্ষা করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
তবুও বাংলাদেশ ব্যাংকের আশ্বাস, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে কোনো সমস্যা হবে না। ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন ও আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সময় এসেছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং কঠোর নজরদারির মাধ্যমে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। তা না হলে এই সংকট শুধু ব্যাংক খাত নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য হয়ে উঠবে অশনিসংকেত।