ঢাকা,  শুক্রবার
১৮ এপ্রিল ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব: এক শতকের রক্তাক্ত ইতিহাস ও গাজায় চলমান বিপর্যয়

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ১০ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১১:০২, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব: এক শতকের রক্তাক্ত ইতিহাস ও গাজায় চলমান বিপর্যয়

গাজা

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও সহিংস দ্বন্দ্বগুলোর একটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধ। শত বছরের এই রক্তাক্ত ইতিহাস আজও থেমে নেই; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল ও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েল ও গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সাম্প্রতিক যুদ্ধ সেই জটিলতারই এক নির্মম বহিঃপ্রকাশ।


শুরু যেখানে: ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণা

অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সে সময় এই ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব জনগণ, সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করতেন ইহুদিরা।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর ‘বালফোর ঘোষণায়’ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। জায়নবাদী এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং শুরু হয় আরব-ইহুদি বিরোধ।


হলোকাস্ট ও ইহুদি আগমন: ফিলিস্তিনে উত্তেজনার বিস্ফোরণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময় নাৎসি বাহিনীর হাতে ৬০ লাখ ইহুদি নিধনের (হলোকাস্ট) পর ইহুদি জনগণের জন্য নিরাপদ আবাসভূমির দাবি জোরালো হয়।
এই সময় ইউরোপ থেকে বিপুলসংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে—ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়।
ইহুদিদের ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাবনায় ৫৬ শতাংশ জমি তাদের দেওয়ায় আরব দেশগুলো এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে।


১৯৪৮: ইসরায়েলের জন্ম ও 'নাকবা'র শুরু

১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ঠিক আগেই ইহুদি নেতারা স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি দেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এ যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হয় এবং অধিকাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে নেয়। প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়ে পড়ে—এই ঘটনাই ‘নাকবা’ নামে পরিচিত।


১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ: দখলদারির নতুন অধ্যায়

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আবারও আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়। মাত্র ছয় দিনেই ইসরায়েল মিসরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি এবং জর্ডান থেকে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়।
এই যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশ ভূখণ্ড চলে যায় ইসরায়েলের দখলে। যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশই এসব দখলকে বৈধতা দেয়নি।


গাজায় ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ ও হামাসের উত্থান

গাজা উপত্যকা, মাত্র ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত—বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলে থাকা গাজা থেকে ২০০৫ সালে সেনা ও বসতি প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েল। তবে সীমান্ত, আকাশপথ এবং উপকূলরেখার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখে দেয়।

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গাজায় জয়লাভ করে হামাস। এরপর থেকে গাজা শাসন করছে এই স্বাধীনতাকামী সংগঠন। হামাস-ইসরায়েল বিরোধ বারবার সংঘাতে রূপ নেয়।
জাতিসংঘ আজও গাজাকে ইসরায়েল-অধিকৃত এলাকা হিসেবে গণ্য করে।


গাজায় মানবিক সংকট

ইসরায়েলের নাকাবন্দি ও বারবারের সামরিক হামলায় গাজা রূপ নিয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের এক উদাহরণে।
প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যার অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে, বেকারত্বের হার পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
বিদ্যুৎ, খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসার অপ্রতুলতায় গাজা পরিণত হয়েছে খোলা আকাশের এক কারাগারে।


সাম্প্রতিক যুদ্ধ: আরও এক অধ্যায়ের শুরু

২০২৩ ও ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়।
বোমা হামলা, রকেট ছোড়াছুঁড়ি, শিশুসহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মিছিল—সবকিছু মিলে আবারও গাজা হয়েছে খবরের শিরোনাম।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দিলেও স্থায়ী সমাধান এখনও অধরাই থেকে গেছে।


শেষ কথা

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুধু দুটি জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব নয়; এটি ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি জটিল গিঁট।
গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান সহিংসতা প্রমাণ করে, যুদ্ধ নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক শান্তি প্রতিষ্ঠাই হতে পারে এই সংকটের একমাত্র সমাধান।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531