পান্তা
‘পান্তাভাতের জল, তিন পুরুষের বল’—এই প্রবাদটি নতুন করে সত্যি করে তুলেছে যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক। গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত পান্তাভাত এখন পুষ্টিবিজ্ঞানীদের চোখে এক অনন্য স্বাস্থ্যকর খাবার। শুধু বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখ উপলক্ষে একদিনের ঐতিহ্য নয়, প্রতিদিনের খাবার হিসেবেও পান্তা হয়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অন্যতম উৎস—এমনটাই বলছে সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা।
গবেষণায় যা উঠে এসেছে
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী "Food and Humanity"-তে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে, পান্তাভাতে রয়েছে প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ অণুজীব, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে এতে লুকিয়ে রয়েছে একাধিক অণুপুষ্টি উপাদান যেমন:
-
লৌহ
-
ক্যালসিয়াম
-
জিংক
-
কপার
-
ম্যাঙ্গানিজ
-
ম্যাগনেশিয়াম
-
বোরন
-
পটাশিয়াম
পান্তার এসব উপাদান সাধারণ রান্না করা ভাতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। যেমন, প্রতি ২.৫ গ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ০.৫ মাইক্রোগ্রাম লৌহ থাকে, সেখানে পান্তাভাতে তা প্রায় ১ মাইক্রোগ্রাম। ক্যালসিয়ামের মাত্রাও চার গুণ বেশি।
রক্তে শর্করার বৃদ্ধির হার কম
এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পান্তাভাত খাওয়ার পর রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক ভাতের তুলনায় ধীরে বৃদ্ধি পায়। যা ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন-সংবেদনশীল রোগীদের জন্য হতে পারে আশীর্বাদস্বরূপ।
গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন কে?
গবেষণাটি পরিচালনা করেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটি-এর অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন সরকার, যিনি বলেন, "আমরা সাধারণ ভাত ও পান্তাভাতের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখতে পেয়েছি, পান্তায় ১০ গুণ বা তারও বেশি উপকারী অণুজীব থাকে। এটি স্বল্প খরচের পুষ্টিকর খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে অপুষ্টির সমস্যা প্রকট।"
গবেষণার পদ্ধতি
যুক্তরাজ্যের মিডলসব্রো শহরে বসবাসকারী একটি বাঙালি পরিবারের ১৩ সদস্যের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় ব্যবহৃত হয় সাদা বাসমতী চাল, যা পানি দিয়ে রেখে ফারমেন্টেশন বা গাজনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পান্তাভাতে রূপান্তর করা হয়। এরপর অংশগ্রহণকারীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বিশ্লেষণ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক খালেদা ইসলাম বলেন, “গবেষণায় অভিনবত্ব রয়েছে। এটি আরও বিস্তৃত পরিসরে হলে পান্তার পুষ্টিগুণ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা যাবে।”
অন্যদিকে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, “গাজনের ফলে ভাতে থাকা আঁশ ও পুষ্টি উপাদান সহজেই অবমুক্ত হয়, যা দেহের জন্য খুব উপকারী।”
এই গবেষণা কেবল পান্তাভাতের ঐতিহ্যিক গুরুত্বই নয়, বরং আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানে এর বাস্তব উপযোগিতাও প্রমাণ করল। পান্তা এখন আর শুধুই গরিবের খাবার নয়—এটি হতে পারে সুস্থ জীবনের এক সহজলভ্য, সাশ্রয়ী ও কার্যকর খাদ্য।
বাংলা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ পান্তাভাত—নতুন করে মিলছে তার পরিচয়: পুষ্টির আধার, সুস্থতার বন্ধুরূপে।



.png)
.png)