
স্বাস্থ্যখাত
দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত ১৮ কোটির বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশ বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ধারাবাহিকভাবে মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ, এবং তরুণ ও দক্ষ জনশক্তির প্রাচুর্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আগামী দশকে আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২৫টি অর্থনীতির একটি হয়ে উঠবে—এমন ভবিষ্যদ্বাণীও পাওয়া যাচ্ছে।
এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা খাত। দ্রুত প্রসারমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং সচেতন জনগোষ্ঠীর কারণে উন্নত স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের বিনিয়োগ-সহায়ক নীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ: এখনই সঠিক সময়
বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য খাত প্রতি বছর ১০ শতাংশের বেশি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে, যা মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তিগত ব্যয়, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বেসরকারি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৫ শতাংশের বেশি আসে বেসরকারি খাত থেকে, যা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল এক সুযোগ সৃষ্টি করছে।
স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দিক থেকে এখনো অনেক ঘাটতি বিদ্যমান—প্রতি হাজার জনে মাত্র একটি শয্যা এবং পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাব—যা বিনিয়োগকারীদের জন্য একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই অবকাঠামো গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, এবং টেলিমেডিসিনের মতো ক্ষেত্রে এই ঘাটতি বিশেষভাবে দৃশ্যমান।
ওষুধ শিল্পে আন্তর্জাতিক অবস্থান
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ। ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে দেশটি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ দিয়ে পূরণ হচ্ছে। এই খাতে এপিআই (API), জৈবপ্রযুক্তি (বায়োটেক), এবং ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ ও উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ ব্যাপক।
স্বাস্থ্য বিমা: এক বিশাল অনাবিষ্কৃত বাজার
বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অবারিত সুযোগ নির্দেশ করে—বিস্তৃত স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প গড়ে তোলা যা চিকিৎসা ব্যয়ের আর্থিক চাপ হ্রাসের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশযোগ্যতা বাড়াবে।
ডিজিটাল স্বাস্থ্য: প্রযুক্তির ছোঁয়ায় খাতের রূপান্তর
বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাস্থ্য খাত বছরে গড়ে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টেলিমেডিসিন, রিমোট মনিটরিং, স্বাস্থ্য অ্যাপ্লিকেশন, এবং ক্লিনিক্যাল ডেটা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকে সহজ ও সাশ্রয়ী করছে।
সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার শতভাগ বিদেশি মালিকানার অনুমতি, কর ছাড়, এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুবিধাজনক পরিবেশের ব্যবস্থা রেখেছে। স্বাস্থ্য খাতে এ ধরনের নীতিগত সহায়তা এই খাতকে এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত শুধু মানবিক প্রয়োজন নয়, বরং এক সুবৃহৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখনই বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়, যখন বাজারে প্রবেশ করে ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। স্বাস্থ্য অবকাঠামো, ওষুধ শিল্প, ডিজিটাল স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য বিমা ও প্রশিক্ষণে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা এই খাতে নেতৃত্বের অবস্থানে আসার সুযোগ পাচ্ছেন।
এক কথায়, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ মানেই হলো—জনস্বার্থ ও মুনাফা—উভয়ের মধ্যেই ভারসাম্য রক্ষা করে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গঠন।