ঢাকা,  শনিবার
২৬ এপ্রিল ২০২৫

Advertisement
Advertisement

রাউজানে আট মাসে ১২ খুন, অধিকাংশ ঘটনায় ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১৬:৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

রাউজানে আট মাসে ১২ খুন, অধিকাংশ ঘটনায় ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

রাউজান

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে উপজেলাটিতে। প্রকাশ্যে গুলি করে, পিটিয়ে কিংবা নিখোঁজের পর লাশ উদ্ধার হওয়া— এসব হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অটোরিকশাচালকসহ সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। খুনের পর মামলা হয়েছে ঠিকই, তবে বেশির ভাগেই ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামিদের বিরুদ্ধে। যেসব মামলায় আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরছে না— এমন অভিযোগ নিহতদের স্বজনদের।

যুবদলকর্মী মানিক খুন: আতঙ্কে এলাকা ছাড়লেন পরিবার

গত শনিবার মধ্যরাতে রাউজানের শমশেরনগর এলাকায় বাসায় রাতের খাবার খাওয়ার সময় যুবদলকর্মী মানিক আবদুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মানিকের স্ত্রী চেমন আরা সোমবার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও কয়েকজন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করে। এরপরই পরিবারটি দুই সন্তান নিয়ে আতঙ্কে রাউজান ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যান।

চেমন আরার অভিযোগ, পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করেছে। সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত থানায় অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় রাজনীতিক ও প্রতিবেশীরা।

একই পরিণতি জাহাঙ্গীরের পরিবারের

গত জানুয়ারিতে জুমার নামাজে যাওয়ার পথে নোয়াপাড়ার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলায় বিএনপি-সম্পৃক্ত কয়েকজনকে আসামি করা হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল। তবে তার স্ত্রী আতঙ্কে সন্তানদের নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে গেছেন।

একটার পর একটা খুন, পুলিশ নির্বিকার

গত আট মাসে রাউজানে যে ১২টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ১০টি মামলায় কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে নিখোঁজ থাকার পর। এমনকি কোথাও পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতেও সাহস পাননি তারা। মাওলানা আবু তাহের, মো. ইউসুফ মিয়া ও মো. হাসানের ঘটনায় পুলিশ নিজেরা বাদী হয়ে অপমৃত্যু বা অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

পুলিশ বলছে, আসামি ধরতে চাপ, বাদী বলছেন ‘তারা ঘুরছে’

তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রাজনৈতিক চাপে আছেন। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় এক কথায় অভিযোগ— বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। পুলিশের দাবি, থানা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এই রাজনৈতিক বলয়, এমনকি মামলার এজাহার তৈরিতেও হস্তক্ষেপ করেন তারা।

অন্যদিকে, অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা সমকালের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো প্রশ্ন তোলেন— পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয়?

অভিযোগ উঠছে প্রশাসনিক অস্থিরতার

গত আট মাসে রাউজান থানায় চারবার ওসি বদল হয়েছে। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার ও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বারবার পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে অসন্তোষ জানানো হলেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই।

ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডগুলো এতটাই পরিকল্পিত যে তা ঠেকানো সহজ নয়। তবে তিনি জড়িতদের ধরতে কাজ করছেন বলে জানান।

রাজনীতি বনাম নিরাপত্তা: জনজীবনে ভয়ের ছায়া

যেসব হত্যা মামলায় আসামিদের নাম রয়েছে, সেই সব মামলার বাদীরা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরছে। কমর উদ্দিন জিতু হত্যা মামলার বাদী ডেইজি আকতার বলেন, “আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছে। আমি ১৬ জনের নাম দিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকেও পুলিশ ধরেনি।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “সন্ত্রাসীরা অনেক সময় পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়।” পরে তিনি রেঞ্জ ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছেন আসামিদের ধরতে। তবে তার এই প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান এলাকাবাসী।


রাউজান এখন খুনের ভূখণ্ড। সন্ত্রাস, রাজনৈতিক আধিপত্য, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং পুলিশি গড়িমসির এক করুণ চিত্র হয়ে উঠেছে এই জনপদ। পরিবার হারিয়ে যারা মামলা করে সাহস দেখাচ্ছেন, তারাও এলাকায় থাকতে পারছেন না। আর যেসব পরিবার ভয়ে চুপ— তাদের গল্প সংবাদেও আসে না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাউজান পরিণত হতে পারে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার প্রতীকী এলাকায়।

Advertisement
Advertisement

আরো পড়ুন  


Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531