ঢাকা,  বুধবার
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Advertisement
Advertisement

ঢাকায় হাতে বানানো জুতা পাওয়া যায় যেখানে

প্রকাশিত: ১৫:০৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঢাকায় হাতে বানানো জুতা পাওয়া যায় যেখানে

হাতে বানানো ‍জুতা

অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি, পাচ্ছি না। ভাবলাম, নেমে যাই। এরপর দেখি আশপাশে জিজ্ঞেস করে। জিগাতলায় জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের গলির মুখে এসে ভাড়া চুকিয়ে রিকশা থেকে যেই নামতে যাব, আমাদের কথা বুঝতে পেরে রিকশাওয়ালা মামা বললেন, ‘চলেন, আপনাগো এক্কেবারে জুতার কারখানার সামনেই দিয়া আহি। সামনের আরও দুটি গলি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম হাতে বানানো জুতার রাজ্যে। ঠিকানা মূলত ধানমন্ডি ৮/এ, কিন্তু লোকে এখনো ধানমন্ডি পুরোনো ১৫ নম্বর রোড বলেই অভ্যস্ত। পরপর বেশ কটি দোকানদ্য নিউ সঞ্জীব শুজ, জোনাকি শুজ, নিউ বাবুল শু অ্যান্ড লেদার ক্র্যাফট, গোলাপ শুজ, অপর্ণা শুজ, নিউ রোড স্টার শুজ, আবদুল্লাহ ফুট ওয়্যারসহ আরও কত কি নামের জুতার দোকান। রাস্তার পাশেই দোকান। দোকানে স্তরে স্তরে সাজানো জুতা। কোনো দোকানে ক্রেতার অর্ডার নেওয়া হচ্ছে, কোনো দোকানে অর্ডারের জুতা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোনোটায় আবার নকশা অনুযায়ী জুতা বানানো নিয়ে ক্রেতাবিক্রেতায় চলছে আলাপ।

নিউ বাবুল শু অ্যান্ড লেদার ক্র্যাফটে আসল চামড়ায় পছন্দসই জুতা বানাতে উত্তরা থেকে ছুটে এসেছেন তাহসিন আহমেদ খান। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী ঘোড়া চালাতে পারদর্শী। ঘোড়ায় চড়ার সময় গায়ে থাকে বিশেষ পোশাক আর পায়ে বিশেষ জুতা, নাম ‘কাউবয় বুট। উঁচু হিলের এই কাউবয় বুট উঠে যায় একেবারে হাঁটু পর্যন্ত। এক হাতে সঙ্গে আনা কাউবয় বুট, অন্য হাতে মুঠোফোনে থাকা পছন্দের নকশা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কেমন ধরনের কাউবয় বুট চান।

বাবুল শুজের বর্তমান ব্যবস্থাপক গণেশ রবিদাস জানালেন, এমন এক জোড়া কাউবয় বুট তৈরি করতে তাহসিনকে গুনতে হবে ১৫ হাজার টাকা। তবে আজকে দোকানের প্রথম ক্রেতা বলে দুই হাজার টাকা ছাড় পেলেন তাহসিন। ফলে ১৩ হাজার টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন পছন্দসই টেকসই নতুন এক জোড়া কাউবয় বুট।

তাহসিনের মতো শুধু উত্তরা থেকেই নয়, টঙ্গী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিলেটসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে পশ্চিম ধানমন্ডির এই পুরোনো ১৫ নম্বর রোডে ফরমাশ নিয়ে আসে লোকজন।

জুতার কারিগরদের আস্তানা

রাস্তার সারি সারি জুতার দোকানের ঠিক পেছনেই কারখানা, বন্ধ ঘরে নিপুণ হাতে সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে চলেছেন কারিগরেরা। নিউ সঞ্জীব শুজের কারখানার ছোট্ট ঘরের তিন প্রান্তে তিনজন কাজ করছেন। পাকা ঘরটার মেঝে থেকে ছয় ফুট কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠলে মেলে আরেকটি মেঝে, সেখানেও কাজ চলছে।

বাবু রবিদাসের সঙ্গে কথা হলো। ১৯৫৪ সাল থেকে জুতা বানানোর কাজ করছেন ৯০ বছর বয়সী এই কারিগর। রবি দাস জানান, কয়েকটি ধাপে জুতা বানানোর কাজ চলে।

প্রথম ধাপে, ওপরের মেঝেতে নির্দিষ্ট মাপের চামড়া কেটে তৈরি করা হয় একেক জোড়া জুতার মাপ। চামড়ার এই অংশকে বলে ‘আপার অংশ। শংকর, প্রদীপ আর হীরা নামের তিন কারিগর এই কাজ করেন।

দ্বিতীয় ধাপে বাবু রবিদাস ও স্বপন রবিদাস বাবলা কাঠের ছাঁচে (ডাইস) আপার অংশ বসিয়ে হাতুড়ি, পেরেক সহযোগে জুতার মূল কাঠামো গড়ে দেন। একেক নকশার জুতার জন্য একেক রকমের ছাঁচ। স্বপন রবিদাস জানান, কিছুদিন আগেই বংশাল থেকে ২৬ জোড়া নতুন ছাঁচ বানিয়ে এনেছেন। প্রতি জোড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা করে। এখনো অনেক ছাঁচ ঘরের দেয়ালজোড়া তাকে তুলে রাখা আছে। নির্দিষ্ট নকশা ও গড়নের জুতার চাহিদা ফুরিয়ে গেলে সেসব ছাঁচও অচল হয়ে পড়ে। এ মাসের শুরুতেই অকেজো হয়ে পড়া দুই ট্রাক ছাঁচ ফেলে দিতে হয়েছে।

যে ধরনের জুতা বানানো যাবে

বানানো যাবে ফরমাল শু, হাফ শু, ক্যাজুয়াল শু, লোফার, চেলসি বুট, কাউবয় বুট, নাগরা, স্নিকার, কেডসসহ রং ও নকশা অনুযায়ী যেকোনো রকমের চামড়ার জুতা। স্যান্ডেল সাধারণত বানানো হয় না। ১২ জোড়া বা তার বেশি ফরমাশ এলে স্যান্ডেল জুতা বানানোর অর্ডার নেয় এখানকার সব কটি দোকান। এসব দোকানে নারী ও ১০ বছরের নিচের বয়সী শিশুদের জুতা বানানোর চল নেই।

বাজারে নামকরা সব ব্র্যান্ড থাকতেও কেন কারিগরের হাতে বানানো দোকানে ফরমাশ আসে? এমন প্রশ্নের উত্তরে গণেশ রবিদাস জানান, প্রথমত, আসল চামড়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। বাজারে নির্দিষ্ট কিছু আকারের বাইরের জুতা পাওয়া মুশকিল। এখানে আছে পায়ের মাপ অনুযায়ী জুতা বানানোর সুযোগ। আবার দেখা গেল আকার মিললেও জুতার রং নকশা পছন্দ হচ্ছে না। এখানে পাচ্ছেন পছন্দের রং ও নকশায় জুতা বানিয়ে নেওয়ার সুযোগ।

জন্মগতভাবে কারও কারও পায়ের সমস্যা থাকতে পারে, এক পা ছোট তো অন্য পা বড়, কোনো পায়ে পাঁচ তো কোনো পায়ে ছয় আঙুল। আবার কারও পায়ের পাতা থাকতে পারে বাঁকা। কেউ বা আবার অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পায়ের সমস্যায় ভোগেন। এসব ক্ষেত্রে বাজারে ঘুরে জুতা না মিললেও এখানে মিলবে সেসব জুতা বানিয়ে নেওয়ার সুযোগ। আসল চামড়ায় বানানো জুতার সঙ্গে আছে ওয়ারেন্টি সুবিধা। সব রকম জুতাতেই ছয় মাস থেকে এক বছরের ওয়ারেন্টিসুবিধা পাবেন। এই সময়ের মধ্যে জুতার সোল ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া সব রকমের সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

যেমন খরচ

সাধারণত ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে পছন্দসই জুতা বানানো যায়। কিছু কিছু জুতার ক্ষেত্রে জুতার গঠন, নকশা ও হাতের কাজের বাড়তি সংযোজনের জন্য দাম ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজারেও গিয়ে ঠেকে।

যেখানে যেখানে মিলবে এমন দোকান

হাজারীবাগের পরে হাতে বানানো জুতার দোকান সবচেয়ে বেশি আছে পুরান ঢাকার দিকে। পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার, আলু বাজার, বংশাল, মালিটোলা, মোগলটুলীসহ ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ নম্বর রোড, মিরপুর ১০, ১১, ১২, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, পান্থপথ, মৌচাক মার্কেটের নিকটবর্তী সিদ্ধেশ্বরী রোড, টিকাটুলি কালীমন্দিরের পাশেসহ ঢাকার অনেক জায়গাতেই পেয়ে যাবেন কারিগরের হাতে বানানো চামড়ার জুতা।

Advertisement
Advertisement

Notice: Undefined variable: sAddThis in /home/dikdorshon/public_html/details.php on line 531