ক্যানসার
ক্যানসার কী?
অস্বাভাবিক কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ হলো ক্যানসার। এই কোষগুলো শরীরের স্বাভাবিক টিস্যুতে অনুপ্রবেশ করে ক্ষতি করতে থাকে। ইদানীং নানাবিধ রাসায়নিক, দূষণ ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে ক্যানসারের মতো জটিল রোগ বেড়ে চলছে। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এখন ক্যানসার। তবে স্ক্রিনিং, সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ কৌশলের অগ্রগতি অনেক ক্যানসার রোগীর বেঁচে থাকার হারকে উন্নত করেছে।
ক্যানসার হলো জেনেটিক মিউটেশনের ফল যা কোষের স্বাভাবিক কার্যকারিতা পরিবর্তন করে। এই মিউটেশনগুলো দ্রুত কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। যার ফলে সৃষ্টি হয় টিউমার। এই টিউমার নিরীহ বা বিনাইন এবং ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যানসারাস হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারগুলোর কাছাকাছি টিস্যুকে আক্রমণ করার এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রয়েছে, একে বলে মেটাস্ট্যাসিস।
ক্যানসারের লক্ষণ কী
রোগের ধরন এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ক্যানসারের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ক্লান্তি বা অবসাদ, কোথাও কোনো পিণ্ড বা গোটা, ওজন হ্রাস, ত্বকের পরিবর্তন, জন্ডিস, নতুন তিল বা বিদ্যমান মোলের পরিবর্তন, মল বা মূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা শ্বাসকষ্ট, গিলতে অসুবিধা বা গলায় কিছু আটকে যাওয়ার অনুভূতি। বদহজম, খাওয়ার পরে অস্বস্তি বা ব্যথা, পেশি বা জয়েন্টে ব্যথা, অকারণে তীব্র ব্যথা, দীর্ঘমেয়াদি জ্বর এবং রাতে ঘাম, শরীরের কোথাও অস্বাভাবিক রক্তপাত বা রক্ত জমাট বাঁধা ইত্যাদি।
যদি এই উপসর্গগুলো দেখা যায়, তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।
প্রাথমিক শনাক্তকরণ
কোনো উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও ক্যানসারের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে উপযুক্ত স্ক্রিনিং করা যায়। জানা যাক ঝুঁকিগুলো কী।
বয়স: বয়সের সঙ্গে ক্যানসার হওয়ার আশংকা বাড়ে। যদিও যেকোনো বয়সে যে কাউকে ক্যানসার আক্রমণ করতে পারে, তবে বেশির ভাগ ক্যানসার ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
জীবনধারা: ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং কায়িক শ্রমহীনতা ও স্থূলতা ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
জেনেটিক ফ্যাক্টর: কিছু ক্যানসারে পারিবারিক পূর্ব ইতিহাস থাকে। জেনেটিক পরীক্ষা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মিউটেশন শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী রোগ: আলসারেটিভ কোলাইটিস, হেপাটাইটিস, খাদ্যনালির প্রদাহ ইত্যাদি নির্দিষ্ট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
পরিবেশগত উপাদান: পরিবেশে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি, দূষণকারী ও বিষাক্ত পদার্থ ও দূষণ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে পরোক্ষ ধোঁয়া এবং পেশাগত ঝুঁকি।
ক্যানসারের জটিলতা
ক্যানসার রোগ এবং এর চিকিৎসা উভয় থেকেই দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা।
ব্যথা: ক্যানসারের কারণে বা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হতে পারে ব্যথা।
ক্লান্তি: ক্যানসার রোগীদের একটি সাধারণ সমস্যা ব্যথা। কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার কারণে প্রায়ই এটা বাড়তে পারে।
শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: ক্যানসার বা চিকিৎসার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
বমি বমি ভাব: ক্যানসারের চিকিৎসার আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বমি বমি ভাব। ক্যানসার রোগ এবং এর চিকিৎসা উভয় থেকেই দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা
অন্ত্রের সমস্যা: ক্যানসার এবং চিকিৎসার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া হতে পারে।
ওজন হ্রাস: ক্যানসার পুষ্টির শোষণকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে রুচি কমে ওজন হ্রাস করতে পারে।
স্নায়ুজনিত সমস্যা: স্নায়ুতে প্রদাহ, ব্যথা ও বৈকল্য হতে পারে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের ক্যানসার মাথাব্যথা বা স্নায়বিক ঘাটতির কারণ হতে পারে।
চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে—
১. সার্জারি: টিউমার ও পার্শ্ববর্তী টিস্যু অপসারণের জন্য সার্জারির প্রয়োজন হয়।
২. রেডিয়েশন: উচ্চশক্তির তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ ক্যানসারের কোষ মেরে ফেলতে বা টিউমার সংকুচিত করতে ব্যবহৃত হয়।
৩. কেমোথেরাপি: ক্যানসার কোষসহ দ্রুত বিভাজক কোষকে ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয় এই ওষুধ।
৪. ইমিউনোথেরাপি: ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগায় এই পদ্ধতি।
৫. টার্গেটেড থেরাপি: সুনির্দিষ্টভাবে ক্যানসার কোষের মিউটেশনকে লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা হয় এই ওষুধ।
৬.হরমোনাল থেরাপি: হরমোন দ্বারা প্রভাবিত কিছু ক্যানসার যেমন স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যানসারে এই থেরাপি ব্যবহৃত হয়।
প্রতিরোধ
ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে জীবনধারা পরিবর্তন জরুরি। ধূমপান ত্যাগ করুন। তামাক এড়িয়ে চললে একাধিক ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়। সরাসরি সূর্যের আলোর সংস্পর্শ সীমিত করুন। সানস্ক্রিন ব্যবহার, সুরক্ষামূলক পোশাক পরার মাধ্যমে ক্ষতিকারক অতি বেগুনি রশ্মি থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। স্বাস্থ্যকর ডায়েট যেমন ফল, সবজি, গোটা শস্য এবং চর্বিহীন প্রোটিনসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করবে। নিয়মিত ব্যায়াম করে সঠিক ওজন বজায় রাখতে পারলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমবে। সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিটের শারীরিক ব্যায়াম দরকার। নিয়মিত স্ক্রিনিং ক্যানসার শনাক্তে সাহায্য করে। কিছু টিকা ক্যানসার ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত। ভ্যাকসিন এই ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম মোস্তফা, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ একাডেমি অব প্যাথলজি ও চিফ কনসালট্যান্ট (প্যাথলজি) আনোয়ারা মেডিকেল সার্ভিসেস, ধানমন্ডি, ঢাকা