
ব্যারি সিনড্রোম
সতর্ক না থাকলে প্রাণঘাতী হতে পারে জিবিএস, চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ
গুলেন ব্যারি সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস নামটি অনেকের কাছে অচেনা হলেও বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কম নয়। এটি একটি স্নায়বিক রোগ, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ফলে ঘটে। সাধারণত ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সংক্রমণের পর কিছু মানুষের শরীর এমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, যার ফলে নিজ শরীরের স্নায়ুকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ক্যাম্পাইলোব্যাকটর জেজুনি’ নামক একটি ব্যাকটেরিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এই রোগের অন্যতম কারণ। ডায়রিয়া বা সর্দি-জ্বরের দুই সপ্তাহ পর হঠাৎ করেই পা দুটো দুর্বল হয়ে আসা, ধীরে ধীরে তা হাত, মেরুদণ্ড, এমনকি মুখের মাংসপেশিতেও ছড়িয়ে পড়া—এই উপসর্গগুলো জিবিএসের লক্ষণ হতে পারে। রোগীর দুর্বলতা এতটাই প্রকট হয় যে অনেক সময় হাত-পায়ের আঙুল নাড়ানোও কষ্টকর হয়ে পড়ে।
জীবনঘাতী রূপ নিতে পারে
জিবিএসের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিক হলো, রোগী যদি শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা অনুভব করেন, তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে আইসিইউ-তে ভর্তি করতে হয়। বুকের পেশি দুর্বল হয়ে গেলে শ্বাস নিতে না পারার কারণে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। তবে আশার কথা হলো, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি, চেতনা বা মল-মূত্র ত্যাগের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
চিকিৎসা ও সেবাযত্ন
জিবিএস রোগীর চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্ব ও সচেতনতার সঙ্গে করতে হয়। নিউরোলজিস্টরা রোগ নির্ণয়ের জন্য শারীরিক পরীক্ষা, এনসিএস (নার্ভ কন্ডাকশন স্টাডি) এবং সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড টেস্ট (CSF) করে থাকেন।
চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় ব্যয়বহুল প্লাজমাফেরোসিস অথবা আইভি ইমিউনোগ্লোবুলিন (IVIG)। তবে এটি কার্যকর তখনই হয় যখন উপসর্গ শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যেই চিকিৎসা শুরু করা হয়। দেরি হলে চিকিৎসার কার্যকারিতা অনেকটাই কমে যায়।
রোগীর শারীরিক যত্নের পাশাপাশি দরকার স্নায়ুবিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পুষ্টি, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং মানসিক সাপোর্ট। পুরোপুরি সেরে উঠতে কোনো কোনো রোগীর ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
আরোগ্য সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
জিবিএস আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন, তবে ৫-১০ শতাংশের মধ্যে কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। মৃত্যুর হার ৫-৬ শতাংশ। তাই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ডায়রিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের দুই–তিন সপ্তাহ পর জিবিএস দেখা দিতে পারে। এছাড়া কখনো কখনো টিকা নেওয়ার পরেও এই রোগ দেখা দিতে পারে, যদিও এটি বিরল ঘটনা।
সচেতনতা ও আগাম সতর্কতাই বাঁচার উপায়
সাধারণ সংক্রমণ যেমন ডায়রিয়া বা ভাইরাসজনিত জ্বরকে অবহেলা না করে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখা, এবং পরবর্তী শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য রাখলে জিবিএস প্রতিরোধ করা সম্ভব। সময়মতো চিকিৎসা শুরু হলে এই বিপজ্জনক রোগ থেকেও মুক্তি মিলতে পারে।
সতর্ক থাকুন, সময়মতো চিকিৎসা নিন—জীবন বাঁচান।
জিবিএসকে অবহেলা নয়, সচেতনতা হোক প্রতিরোধের চাবিকাঠি।