
ইরানি কার্পেট
‘তেহরান কার্পেট মার্কেট’ শুধু বাণিজ্যের নয়, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যেরও প্রতীক
ইরানি কার্পেট বা গালিচার ইতিহাস বহু প্রাচীন ও গৌরবময়। এটি শুধু একটি পণ্য নয়, বরং ইরানি সংস্কৃতির সৃজনশীল শিল্পধারার একটি জীবন্ত প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইরানের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়ে আসছে।
প্রথম দিকে সম্পূর্ণ হাতে বোনা কার্পেট তৈরি হতো। সেসব কার্পেটে বুননের নিখুঁত দক্ষতা, রঙের ছন্দ, জ্যামিতিক বা প্রাকৃতিক মোটিফ এবং নান্দনিক নকশার প্রতিফলন থাকত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এখন মেশিনে তৈরি কার্পেটও ইরানে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। তবু হাতে বোনা কার্পেটের কদর ও মর্যাদা আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
ইরানি কার্পেট: জাতীয় সংস্কৃতির প্রতীক
ইরানি কার্পেট কেবল রপ্তানিযোগ্য একটি বাণিজ্যিক পণ্য নয়, এটি ইরানি জাতির আত্মপরিচয়ের একটি শিল্পিত রূপ। এটি ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির নিপুণ সংমিশ্রণে তৈরি এক গৌরবোজ্জ্বল শিল্পধারা। শত শত বছর ধরে এই শিল্পের সূক্ষ্ম শৈল্পিকতা, নিখুঁত নকশা এবং গুণগত মান ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে বিশ্ব দরবারে।
কার্পেটের মাধ্যমে একেকটি অঞ্চল তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরে। যেমন—কাশান, তাবরিজ, ঈসফাহান, কোম, নাইন প্রভৃতি অঞ্চলের কার্পেট তাদের নিজস্ব নিদর্শন ও নকশার বৈশিষ্ট্যে অনন্য।
তেহরান কার্পেট মার্কেট: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিলনমেলা
ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ‘তেহরান কার্পেট মার্কেট’ দেশের সবচেয়ে বড় এবং পুরোনো কার্পেট মার্কেটগুলোর অন্যতম। এটি কেবল একটি বাজার নয়—একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্র, যেখানে ইতিহাস, শিল্প এবং বাণিজ্য হাত ধরাধরি করে চলে।
এই বাজারে ইরানের নানা অঞ্চল থেকে আসা বৈচিত্র্যময় কার্পেটের সমাহার দেখা যায়—যেমন রেশমি, পশমি বা তুলার কার্পেট, বিভিন্ন আকার ও নকশায়। সনাতন হস্তশিল্প ও আধুনিক কারখানায় তৈরি কার্পেট পাশাপাশি বিক্রি হয় এখানে।
এ বাজারের স্থাপত্যশৈলীতেও ইরানি ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট। পুরোনো স্থাপনা, খিলানপথ, রঙিন দরজা-জানালা ও কারুকাজে ভরপুর এই বাজার শুধু ক্রেতাদের নয়, ইতিহাস ও স্থাপত্য ভালোবাসা মানুষের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ইরানি কার্পেট রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। বিশ্বের বহু দেশে ইরানি কার্পেট উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, বিশেষ করে হাতে বোনা কার্পেটগুলোর জন্য রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কারিগরদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং বুননের সূক্ষ্মতা কার্পেটকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ইউনেস্কো ইতোমধ্যেই ইরানি কার্পেটকে ‘অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই শিল্পের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ও সম্মানকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে।
ইরানি কার্পেট ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প এবং জীবনের গল্প বুনে চলে এক সুদৃশ্য তাঁতে। আর তেহরান কার্পেট মার্কেট সেই গল্পের প্রাণকেন্দ্র—যেখানে শিল্প, অর্থনীতি আর ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয় প্রতিদিন দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের মুগ্ধ করে। এই গালিচা শুধু ঘর সাজায় না, এটি একেকটি জাতির আত্মার বুননও হয়ে ওঠে।